ইতিহাস ও সুন্নাহর আলোকে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী সা.’, ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী প্রবর্তন ও প্রবর্তক : একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

 

মিলাদ শব্দের অর্থ জন্ম বা জন্মদিবস। ‘মিলাদুন্নবী’ বলতে আমরা বুঝি, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সা. এর জন্ম বা জন্মদিবস। আমাদের মুসলিম সমাজে বিভিন্নভাবে মিলাদুন্নবী পালন করা হয়ে থাকে। মিলাদুন্নবী বা নবিজির জন্মদিন কেন্দ্রিক এসব উৎসবকে বলা হয় ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’। দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম সমাজের কোনো কোনো ঘরানার পক্ষ থেকে নবীজির জন্মদিন কেন্দ্রিক উৎসব ঈদে মীলাদুন্নবীকে ‘সাইয়িদুল আ’ইয়াদ’, ‘সকল ঈদের সেরা ঈদ’ বা ‘বড় ঈদ’ বলে প্রচারণা চালানো ও উদযাপন করা হচ্ছে। এখানে দুটি বিষয় বিবেচ্য: ১. ইসলামে ঈদ কয়টি ও ২. মিলাদুন্নবী বা নবিজির জন্মদিন পালনের সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি কী?


হাদীস ও সুন্নাহয় মুসলিম জাতির জন্য শুধু দু’টি ঈদের কথা বলা হয়েছে। আনাস রা. বলেন, নবিজি সা. হিজরত করে মদীনায় এলেন। সে সময় মদীনাবাসীর দু’টি দিবস ছিল; যে দিন দু’টিতে তারা প্রতিবছর খেলাধুলার মাধ্যমে আনন্দ উদযাপন করত। দিবস দুটি সম্পর্কে নবীজি জিজ্ঞাসা করলে তারা জানাল, জাহিলিয়াতের সময় থেকে আমরা দিবস দুটি উদযাপন করে আসছি। নবিজি সা. বললেন, আমি তোমাদের মাঝে এসেছি; আল্লাহ তোমাদেরকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন এর পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিনে। তা হচ্ছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা (সুনান আবু দাউদ, হাদীস-১১৩৪; সুনান নাসায়ি, হাদীস-১৫৫৬; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস-১২৮২৭)।


এমনকি সাহাবি কিরাম রা. যখন নবিজি সা. ও নিজেদের যুগের ঈদের বর্ণনা দিয়েছেন তখন শুধু দু’টি ঈদের কথাই বলেছেন। তাঁদের বর্ণনায় তৃতীয় কোনো ঈদের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। আমরা দুটি বর্ণনা উল্লেখ করছি। আব্দুল্লাহ ইবন ওমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা., আবু বকর ও ওমর রা. ‘দুই ঈদে’র সালাত খুতবার পূর্বে আদায় করতেন (সহীহ বুখারি, হাদিস- ৯৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদিস- ৮৮৮)। জাবির ইবন সামুরা রা. বলেন, আমি বহুবার নবী সা. এর সাথে ‘দুই ঈদে’র সালাত আদায় করেছি আজান ও একামত ছাড়া (সহীহ মুসলিম, হাদিস- ৮৮৭; সুনান আবু দাউদ, হাদীস-১১৪৮)।


এছাড়া মুসলিম উম্মাহর ফিকহের ইমামগণও তাঁদের গবেষণা ও কিতাবসমূহে দুই ঈদ ছাড়া তৃতীয় কোনো ঈদের কথা উল্লেখ করেননি। খাইরুল কুরুন (তিন কল্যাণ যুগ), অর্থাৎ সাহাবি, তাবেয়ি ও তাবে-তাবেয়িদের যুগেও তৃতীয় কোনো ঈদের অস্তিত্ব ছিল বলে ইসলামি ইতিহাস থেকে জানা যায় না। সুতরাং এমন অস্তিত্বহীন বিষয়কে প্রথমত ঈদ বানানো, দ্বিতীয়ত ‘সকল ঈদের সেরা ঈদ’ বলে প্রচারণা চালানো ও উদযাপন করা কোনো সচেতন মসলিমের কাজ হতে পারে না।

(ads2)


বাৎসরিক বনাম সাপ্তাহিক: যারা এভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করেন তারা বাৎসরিকভাবে প্রতি বছর ১২ই রবিউল আওয়ালকে ঈদ হিসাবে উদযাপন করে থাকেন। অথচ সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী সা. তাঁর জন্মদিন পালন করতেন সাপ্তাহিকভাবে এবং তা করতেন সোমবার রোজা পালনের মাধ্যমে। আবু কাতাদাহ রা. বলেন, নবিজিকে তাঁর সোমবার সিয়াম পালন করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি বলেন, এদিন আমি জন্মলাভ করেছি (সহীহ মুসলিম, হাদিস- ১১৬২)।


এ হাদিস থেকে আমরা মিলাদুন্নবী উদযাপনের সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি, অর্থাৎ নবির জন্মদিন পালনের পদ্ধতি তাঁর নিজের কর্ম থেকেই জানতে পারছি। তা বাৎসরিকভাবে কোনো উৎসব-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নয়। বরং সাপ্তাহিকভাবে সোমবার রোজা পালনের মাধ্যমে। উম্মতের কর্তব্য নতুন উদ্ভাবনের পিছে না পড়ে প্রমাণিত সুন্নাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা।


এভাবে কর্মে-বর্জনে সুন্নাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা বললে উদ্ভাবন, প্রচলন ও প্রথাপ্রিয় কিছু মানুষ নানান প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকেন। তারা বলেন, ‘করলে সমস্যা বা ক্ষতি কী? এভাবে আমরা তো ভালো কাজই করছি!’ তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন, নবি সা. ও তাঁর সাহাবিদের বরকতময় সুন্নাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যা কী? আমাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতি ভালো নাকি সুন্নাত ভালো? সুন্নাতের বাইরে নতুন কিছু উদ্ভাবনের প্রয়োজনটাই বা কী? নবিজি তো সুস্পষ্টভাবে বলে গেছেন, যা জান্নাতের নিকটবর্তী করে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখে এমন সবকিছুই তোমাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে (তাবারানি, আল মু’জামুল কাবীর, হাদীস-১৬৪৭)।


প্রথাপ্রিয় কেউ কেউ বলেন, ‘নবিজি করেননি, নিষেধও তো করেননি।’ তাকে আমরা বলতে চাই, আপনি কি বিদআতের পরিচিতি ও পরিণতি জানেন? নবিজি বলেছেন, (দীনের মধ্যে) নবউদ্ভাবিত প্রত্যেকটি বিষয়ই বিদায়াত এবং প্রত্যেক বিদায়াতই ভ্রষ্টতা আর সকল ভ্রষ্টতা জাহান্নামে (সুনান নাসায়ি, হাদীস-১৫৭৮)।

তখন তারা বলেন, ‘এই যে বাস, ফ্যান, মোবাইল, উড়োজাহাজ বিজ্ঞানের এইসব নানা আবিষ্কার, এগুলোও তো নবীযুগে ছিল না, তাহলে কি এগুলো ব্যবহার করাও বিদআত?’ আমরা তাদেরকে বলব, বিদআত সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই। আগে এ বিষয়ে পূর্ণজ্ঞান অর্জন করুন, তারপর কথা বলতে আসুন। মহান আল্লাহ বলেন, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই সে বিষয়ে লিপ্ত হোয়ো না (সূরা ইসরা, আয়াত: ৩৬)।

(ads1)


তাদের এই প্রশ্নও করতে শোনা যায় যে, ‘এতদিন ধরে সমাজের এত মানুষ করছে, তারা সবাই কি ভুল করছে?’ কোনো মুসলিমের পক্ষ থেকে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া উচিৎ নয়। কারণ যুগে যুগে নবী-রাসূলদের হকের দাওয়াতের বিপরীতে কাফির-মুশরিকরা এই ধরণের প্রশ্ন উত্থাপন করত। নবিজি সা. বহু হাদিসে আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, সমাজে ইবাদত হিসাবে বিভ্রান্তিকর অনেক কিছুই উদ্ভাবিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।

তখন আমাদের কর্তব্য সম্পর্কেও তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন, তোমরা কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে রাখবে (মুআত্তা মালিক, হাদীস-১৮৭৪); আমার, আমার সাহাবিদের এবং খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের আনুসরণ করবে (সুনান আবু দাউদ, হাদীস-৪৬০৭; সুনান তিরমিযি, হাদীস-২৬৪১)।


সুতরাং নাজাত পেতে হলে নবি সা. এর এসব নির্দেশনার অনুসরণ করতে হবে। আমাদের অজ্ঞতাপূর্ণ সমাজে কী কী প্রচারিত হল, কতটা ব্যাপকতা লাভ করল সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলে চলবে না। যারা নবি সা. এর সুন্নাত ও নির্দেশনা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে চায় তারাই শুধু এসব অবান্তর প্রশ্নমালার অবতারণা করে।


খেলাফে সুন্নাত বা বিদায়াতের পক্ষের সকল যুক্তিতর্ক যখন শেষ হয়ে যায় তখন এইসব লোক বলে থাকেন, ‘…তবে এইভাবে করলে অন্তরে আবেগ আসে, প্রশান্তি পাওয়া যায়, ভালো লাগে।’


এই সমস্ত ব্যাধিগ্রস্ত লোক মূলত রোগ পুষে রাখতে চায়। যে অন্তর সুন্নাতে প্রশান্তি পায় না সে অন্তর রোগাক্রান্ত। আমাদের কর্তব্য কারো অন্তর এমন হলে তার চিকিৎসার ফিকির করা। কিন্তু তা না করে যদি রোগকেই আরোগ্য ভাবা হয় এবং তা পুষে রেখে আরো বাড়তে থাকার সুযোগ করে দেয়া হয়, তবে কি তা বুদ্ধিমানের কাজ হবে? ‘মনে আবেগ আসে’/‘ভালো কাজই তো করছি এ যুক্তি দিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও তা প্রতিপালনের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে ধ্বংস করে এবং আল্লাহর দীনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।


আমাদের পূর্বের উম্মতরা এসব যুক্তি দিয়েই তাদের নবিদের রেখে যাওয়া দীনের মাঝে সংযোজন-বিয়োজন ও পরিবর্তন করতে করতে সেইসব দীনকে এমন বিকৃত, পরিবর্তন ও বিপরীতমুখী করে ফেলেছে যে, যে দীন আল্লাহ পাঠিয়েছিলেন মানুষের মুক্তি ও সফলতার জন্য সেসব দীনই এখন হয়ে গেছে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ। মহান আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য দীন গ্রহণ করবে তার থেকে কখনোই তা গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখেরাতে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত (সূরা আল ইমরান, আয়াত: ৮৫)।


তবে মানুষের অন্তর বৈচিত্রময় ও পরিবর্তনশীল। কোনো কর্ম ও পদ্ধতিতে তার আবেগ ও উদ্দীপনা আসে, আবার অন্য কর্মে সে অবসাদ বোধ করে। মানুষের কর্তব্য মনের এই আবেগ-অনুভূতি ও জোয়ার-ভাটাকে সুন্নাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা। তার চাহিদা অনুযায়ী বাড়তে না দেয়া। প্রবৃত্তির চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করাই তো সফলতার সোপান, এমনকি ইবাদতের ক্ষেত্রেও। আব্দুল্লাহ ইবন আমর রা. বলেন, নবি সা. বলেছেন, প্রত্যেক আমলের জন্য রয়েছে জোয়ার বা উদ্দীপনা, আবার প্রত্যেক উদ্দীপনার জন্য রয়েছে অবসাদ। যার অন্তরের আবেগ-উদ্দীপনা নিয়ন্ত্রিত হবে আমার সুন্নাত মোতাবেক সে সফল হল। আর যে অন্য পথ অবলম্বন করল সে ধ্বংস হল (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস-৬৯৫৮)।


বিজাতীয় অনুকরণ: প্রামাণ্য হাদিসে নবিজির জন্মেরদিন ও বছর উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু জন্ম তারিখ ও মাস বর্ণিত হয়নি। ঐতিহাসিকগণ তাঁর জন্ম তারিখ বিষয়ে এক ডজনের ঊর্ধ্বে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তেমনি সহিহ হাদিসে তাঁর মৃত্যুর বছর, মাস ও বার উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু মৃত্যু তারিখ বর্ণিত হয়নি। এক্ষেত্রেও ঐতিহাসিকগণ একহালি মত উল্লেখ করেছেন।

(ads2)


এ থেকেও বোঝা যায়, নবিজির জন্ম-মৃত্যুর তারিখ পালনীয় কিছু নয়। নইলে সাহাবায়ে কেরাম, যারা নবিজিকে সবকিছু থেকে অধিক ভালোবাসতেন, সবকিছুর বিনিময়ে তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ করতেন, তাঁরা অবশ্যই তারিখ সংরক্ষণ করতেন, দিবসটি উদযাপন করতেন এবং তাঁদের উদযাপনের ধারাবাহিকায় মুসলিম উম্মাহ প্রজন্ম পরম্পরায় পালন করে আসতেন।


বাস্তবতা এমন হলেও, আমাদের সমাজে রাসূল সা. জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ হিসাবে ১২ রবিউল আওয়ালই একমাত্র প্রসিদ্ধ মত। এখন কথা হচ্ছে, আমরা যখন ধরে নিয়েছি, নবিজির জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে, আর কারো জন্ম-মৃত্যু যদি একই দিনে হয় তবে তার ভক্তদের অন্তরে তো ওই দিনটাতে পাওয়ার আনন্দের চেয়ে হারানোর বেদনাই প্রবল হয়ে থাকে, তাহলে আমরা নবীজির মৃত্যুদিবসের শোকপালন না করে দিবসটাকে শুধু তাঁর জন্মদিনের আনন্দ-উৎসব হিসাবে ঈদ কেন পালন করছি?


এর মূলে এক ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। ক্রুসেড যুদ্ধের মাধ্যমে খ্রিস্টানরা যখন মুসলিম জনপদের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দখল করে নেয়, মুসলিম সমাজ হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত, শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ সবকিছুতেই তারা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এদিকে বিজয়ী খ্রিস্টানরা তাদের নবি ঈসা আ. এর জন্মোৎসব পালন করত মহাসমারোহে। মুসলিমরা বিজয়ী জাতির এ উৎসব দেখে খুবই প্রভাবিত হয়।

(ads1)


তারা ভাবতে থাকে, আমরা যদি এই বিপর্যস্ততা থেকে মুক্তি পাই, যদি কখনো বিজয়ী হতে পারি, তবে আমরাও আমাদের নবির জন্মদিন এভাবে পালন করব। সালাহুদ্দীন আইয়ুবির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম বিশ্বকে বিজয়ী করেন এবং সে সময়ে তার ভগ্নিপতি ইরাকের ইরবিল প্রদেশের শাসক আবু সাঈদ মুযাফফরুদ্দীন কুকুবুরি নবিজির জন্মদিন কেন্দ্রিক মিলাদুন্নবীর উৎসবপালন করা শুরু করেন। এ কারণেই মৃত্যুদিবস তাদের বিবেচনায় আসেনি।


খ্রিস্টান সমাজ তাদের নবির জন্মদিন পালন করে ২৫ ডিসেম্বর। কিন্তু তাদের ধর্মগ্রন্থে যেমন নবির জন্মদিন পালনের কোনো নির্দেশনা নেই, তেমনি ঈসা আ. এর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বরও প্রমাণিত নয়। তাদের অনুকরণ করতে গিয়ে আমাদের অবস্থাও তাদের মতোই হয়েছে। শরীয়তের নির্দেশনা ছাড়াই এক অপ্রমাণিত দিবসে নতুন এক ইবাদতের উদ্ভাবন করেছি আমরা।


অথচ নবি সা. ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিধর্মীদের অনুসরণ করতে বারবার বহুভাবে আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, তোমরা সর্বতভাবে তাদের (আহলে কিতাব, ইয়াহুদি-খ্রিস্টান, মুশরিক, মূর্তিপূজক, অগ্নিপূজক) বিরুদ্ধাচারণ করো (সহীহ বুখারি, হাদিস-৫৮৯২; সহীহ মুসলিম, হাদিস-২৬০; সুনান আবু দাউদ, হাদিস-৬৫২; সহীহ ইবনে হিব্বান-২১৮৬)।


নবিজির আনুগত্যের একটি দিক: আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের মতো নবিজি সা. এর আনুগত্যও ফরজ। আমরা যখন কোনো ইবাদত করি, আল্লাহর দেয়া বিধান আল্লাহর জন্য পালন করি। এটা আল্লাহর আনুগত্য। এখানে নবিজির আনুগত্য মূলত আল্লাহর বিধানটি নবিজির দেখানো-শেখানো পদ্ধতিতে পালন করা।


সুতরাং সুন্নাত পদ্ধতির পরিবর্তনের অর্থ হচ্ছে, নবিজির আনুগত্য বর্জন। কিয়ামতের ময়দানে যাদেরকে হাউজে কাউসারের পাড় থেকে ফিরিয়ে দেয়া হবে তারা কিন্তু দীনবিমুখ মানুষ নয়। বরং যারা দীনের মধ্যে উল্টাপাল্টা করে দীনপালন করেছে তারা। এ কারণেই নবিজি তদেরকে ফিরিয়ে দেবার সময় বলবেন, দূর হও যারা আমার পরে পরিবর্তন করেছ (সহীহ বুখারি, হাদিস-৬৫৮৪, ৭০৫০)। এই পরিবর্তনকেই শরয়ি পরিভাষায় বিদায়াত বলে।

(ads2)


আমরা যুক্তিতর্কের প্যাঁচ দিয়ে যতই ঘুরাই না কেন, সাহাবায়ে কিরাম রা. সোজাসাপ্টা এভাবেই বুঝতেন। আমরা একটি বর্ণনা উল্লেখ করছি। আব্দুল্লাহ ইবন মুগাফফাল রা. এর পুত্র বলেন, আমার বাবা সালাতের মধ্যে আমার ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলতে শুনে ফেলেন। তখন তিনি আমাকে বলেন, বেটা, এটা বিদায়াত। তুমি বিদায়াত থেকে দূরে থাকবে। আমি নবীজির কোনো সাহাবিকে দেখিনি ইসলামে বিদায়াত আবিষ্কারের চেয়ে অন্য কোনো বিষয়ে অধিক ক্রোধান্বিত হতে।


তিনি বলেন, আমি নবিজি সা., আবু বকর, ওমর ও উসমান রা.র পিছে সালাত আদায় করেছি। তাঁদের কাউকে ‘বিসমিল্লাহ’ শুনিয়ে পড়তে শুনিনি। সুতরাং তুমিও তা স্বশব্দে পড়বে না (সুনান তিরমিযি, হাদীস-২৪৪)।

আমরা জানি, সালাতে কেরাতের পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া সুন্নাত। কিন্তু এখানে অনুচ্চ শব্দের স্থানে স্বশব্দে হওয়াকেই সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবন মুগাফফাল রা. বিদায়াত বলে গণ্য করেছেন। আসুন, আমরা আমাদের চিন্তাকে সাহাবির চিন্তার সাথে মিলিয়ে দেখি।


আমরা কেন বিদআতের বিরোধিতা করি: সাহাবায়ে কিরাম রা. বলেছেন, নিয়মিতই মানুষ বিদআত উদ্ভাবন করতে থাকবে আর সুন্নাত মেরে ফেলতে থাকবে। এভাবে একসময় শুধু বিদআতই বেঁচে থাকবে আর সুন্নাত বিলীন হয়ে যাবে। তখন কোনো বিদআত বর্জন করলে সমাজের লোকজন এমনভাবে ক্ষিপ্ত হবে যেন কোনো প্রামাণ্য সুন্নাতকেই বর্জন করা হচ্ছে (তাবারানি, আল মু’জামুল কাবীর, হাদীস-১০৬১০; কুরতুবি, আল বিদাউ, পৃ. ৫৮)।


মুক্তি পেতে হলে সে নাজুক মুহূর্তেও বিদআত ও বিদআতিকে বর্জন করে চলতে হবে এবং সাধ্যমতো বিদআতের বিরোধিতা করে যেতে হবে। এটা আল্লাহর ওলীদের জন্য কর্তব্য। ইবন মাসউদ রা. বলেন, কোনো বিদআত প্রচলনের মাধ্যমে যখনই ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয় তখনই আল্লাহর কোনো ওলী ওই বিদআতের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ান এবং তার লক্ষণগুলো ব্যাখ্যা করতে থাকেন। তোমরা এইসব স্থানে উপস্থিত থাকার সুযোগ হাতছাড়া করবে না (ইবনুল কাইয়িম, জালাউল আওহাম, পৃ. ২১৭)। ইবন মাসউদ রা. নির্দেশিত এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্যই আমরা বিদআতের বিরোধিতা করে থাকি।

(ads1)

উম্মতের উপর নবিজির অধিকার: নবিজিকে আল্লাহ তায়ালা বিশ্বজগতের জন্য রহমত করে প্রেরণ করেছেন। আমাদের উপর তাঁর অপরিসীম করুণা বলার অপেক্ষা রাখে না। এজন্য আমাদের উপর নবিজির অনেক হক রয়েছে। তাঁকে পিতামাতা, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন, ধনসম্পদ, পৃথিবীর সকল মানুষ, এমনকি নিজের জীবন থেকেও বেশি ভালোবাসতে হবে, তাঁকে পাওয়ার শুকরিয়ায় তাঁর আগমন দিবস সোমবারে যথাসম্ভব সিয়াম পালন করতে হবে, বেশির থেকে বেশি তাঁর উপর দরুদ-সালাম পাঠ করতে হবে, তাঁর আদর্শ অনুযায়ী নিজের সমগ্র জীবন পরিচালনা করতে হবে এবং পরিবার, সমাজসহ সর্বত্র তাঁর আদর্শের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের যুক্তিতর্ক সমাজের প্রচলনের পক্ষে না হয়ে তাঁর সুন্নাতের পক্ষে হোক। মহান আল্লাহ তাওফীক দান করুন। আমীন!!

Post a Comment

0 Comments