শবে ক্বদরের তাৎপর্য আল্লামা মুফতী মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহ.)

 


মহান আল্লাহপাক তাঁর হাবিব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়াসিলায় আমাদের মাগফিরাতের জন্য কতিপয় মর্যাদাপূর্ণ দিন ও মহিমন্বিত রাত দান করেছেন, যাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর গোনাহগার বান্দাদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শন করে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। সেসব মহিমান্বিত ও সম্মানিত দিন-রাতের মধ্যে শবে ক্বদর বা লাইলাতুল ক্বদর হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ রজনী।


শবে ক্বদরের অর্থ


শবে ক্বদর, আরবীতে ‘লাইলাতুল ক্বদর’। এর অর্থ হচ্ছে মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ রাত। ইমাম যুহরী (রহ.) ও অন্যান্য উলামায়ে কেরাম এ অর্থই গ্রহণ করেছেন। এ রাতকে লাইলাতুল ক্বদর বলার কারণ হচ্ছে এ রাতের মহিমা ও মর্যাদা। আবু বকর ওরারক (রহ.) বলেন, এ রাতকে এ জন্যই লাইলাতুল ক্বদর বলা হয়েছে যে, ইতোপূর্বে যে ব্যক্তির বেআমলীর কারণে নিজের কোন মর্যাদা বা সম্মান ছিল না, ঐ রাতে তাওবা-ইসতেগফার ও ইবাদতের বদৌলতে সে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়ে যায়।


শবে ক্বদরের ফজীলত


কোরান শরীফ ও হাদীস শরীফে লাইলাতুল ক্বদরের অসংখ্য ফজীলত বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ করে কোরান শরীফে সূরা আল ক্বদর নামক স্বতন্ত্র একটি পূর্ণ সূরা নাযিল হয়েছে। যা পবিত্র কোরানের ৯৭ নম্বর সূরা। এই সূরায় শবে কদরের গুরুত্ব ও মর্যাদা বর্ণনাপূর্বক ঘোষণা করা হয়েছে, শবে ক্বদরের রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। বহু সংখ্যক মুফাস্সির বর্ণনা করেছেন, ঐ রাতে নেক আমল করা শবে ক্বদরবিহীন হাজার মাসের আমলের চেয়েও উত্তম। মদীনা শরীফে ঐ সূরাটি নাযিল হয়েছে। এ সূরার শানে নুযূলের প্রতি লক্ষ করলে শবে ক্বদরের মহিমা ও মর্যাদা আরও পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠে। এ সূরা নাযিলের প্রেক্ষাপট বর্ণনা প্রসঙ্গে মুফাসসিরগণ একাধিক উক্তি উল্লেখ করেছেন।


প্রথম: ইবনে আবি হাতিম বিশিষ্ট তাফসীরকার তাবেয়ী মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনি ইসরাঈলের এমন এক মুজাহিদের ঘটনা বর্ণনা করলেন, যিনি একাধারে এক হাজার মাস পর্যন্ত জেহাদে রত ছিলেন, কখনও যুদ্ধের হাতিয়ার তাঁর হাত থেকে রাখেননি। এ মুজাহিদের পুণ্য কাজের বিবরণ শুনে সাহাবীগণ অবাক হয়ে গেলেন। এরই প্রেক্ষিতে আল্লাহর পক্ষ থেকে সূরা ‘আল ক্বদর’ নাযিল করে সান্ত্বনা প্রদান করা হয়। যে সূরায় উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য শুধুমাত্র একটি রাতের ইবাদত সেই মুজাহিদের সমগ্র জিন্দেগী তথা এক হাজার মাসের পুণ্য কাজের চেয়েও উত্তম বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। (তাফসীরে মাআরেফুল কোরান ও মাজহারী)


দ্বিতীয়: একদিন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, বনী ঈসরাইলের মধ্যে চার ব্যক্তি  [আইয়্যুব (আ.),  জাকারিয়া (আ.), হিযক্বীল ও ইউশ বিন নূন  (আ.)] এমন ছিলেন যারা ৮০ বছর পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদতে মশগুল ছিলেন। এ কথা শুনে সাহাবীগণ বিস্মিত হলেন, তখন জিব্রাইল (আ.) এ সূরা নিয়ে এলে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত আনন্দিত হন।


তৃতীয়: সাহাবীগণ শামউন বা ছামনূন (আ.) এর অধিক ইবাদতের বর্ণনা শুনে হতাশার সুরে আবেদন করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমরা কীভাবে এরূপ ছাওয়াব অর্জন করব! কেননা আমাদের জীবনতো ষাট থেকে সত্তর বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর এক তৃতীয়াংশ ঘুমে, কিছু জীবিকা অর্জনে, কিছু সময় অন্য প্রয়োজনে আবার এর মধ্যে আরও কিছু সময় রোগ বালাই আর অবহেলায় কেটে যায়। অতএব ইবাদতের জন্য আর কিইবা অবশিষ্ট থাকল! এ কথা শুনে নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তাই আল্লাহ পাক তাঁর হাবীবের দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য এ সূরা নাযিল করলেন। 


চতুর্থ: একদা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর উম্মতের বয়সসীমা দেখানো হল যার অধিকাংশ ৬০ থেকে ৭০ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এতে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হলেন যে, এত কম সময়ে আমার উম্মত কি পরিমাণ পুণ্য কাজ করবে! অন্যান্য উম্মত তো অনেক দীর্ঘ জীবনের বদৌলতে কেয়ামতের দিন অনেক বেশি ছওয়াবের অধিকারী হবে। আমার উম্মতের সামান্য নেকীর কারণে কিনা লজ্জিত হতে হয়। তখন আল্লাহ পাক এ সূরা নাযিল করে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত্বনা দিলেন।


পঞ্চম: অন্য বর্ণনায় আছে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাল্লামের মনে একদা এ চিন্তার উদ্রেক হলো যে, আল্লাহ পাক আমার উম্মতের সাথে কী ব্যবহার করবেন! তখন আল্লাহ তায়ালা ওহী পাঠালেন, হে মুহাম্মদ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনার উম্মতের জন্য চিন্তার কোন কারণ নেই, কেননা আমি আপনার উম্মতের এ দুনিয়াতে নবীগণের কোন এক বিশেষত্বে বৈশিষ্ট মন্ডিত না করব, ততক্ষণ তাদের কাউকে দুনিয়া থেকে উঠাব না। নবীগণের মর্যাদাসমূহের অন্যতম হচ্ছে তাঁদের নিকট ফেরেশতাগণ ওহী নিয়ে আসেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদেরকে সালাম পৌঁছান, এরকমই লাইলাতুল ক্বদরে আপনার উম্মতের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হবেন এবং আমার পক্ষ থেকে সালাম ও রহমত পৌঁছে দিবেন। কেননা আমি শবে ক্বদরে আপনার উম্মতের প্রতি ফেরেশতা প্রেরণ করে থাকি। (গুনিয়াতুত তালিবিন)


হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বদরে এশার নামাজের পর সাতবার সূরা ক্বদর ‘ইন্না আনযলানাহু’ পড়ে তাকে আল্লাহপাক সকল বালামুসীবত থেকে রক্ষা করে থাকেন এবং সত্তর হাজার ফেরেশতা তাঁর জন্য জান্নাতের দোয়া করে থাকেন। (উয়ূনুল মাজালিছ, নুযহাতুল মাজালিছ) 


শবে ক্বদর কবে তালাশ করবে? 


পবিত্র কোরানের ভাষ্যমতে, একথা সুষ্পষ্ট যে, শবে ক্বদর মাহে রামজানুল মোবারকেই হয়ে থাকে। কিন্তু এর প্রকৃত তারিখ বর্ণনা প্রসঙ্গে মুফাসসিরগণের অনেক অভিমত রয়েছে। তাফসীরে মাজহারীতে আছে, এসব মতামতের মধ্যে বিশুদ্ধতম মত বর্ণনা হচ্ছে শবে ক্বদর রামাদ্বানুল মোবারকের শেষ ১০ দিনের মধ্যেই হয়। শবে ক্বদরই হচ্ছে উম্মতে মুহাম্মদীর একক বৈশিষ্ট্য। হাদীস শরীফে আছে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদ্বান শরীফের প্রথম ১০ দিনে এতেকাফ করলেন। আবু সাঈদ (রা.) বলেন যে, আমরাও এ এতেকাফে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে ছিলাম। অতঃপর জিব্রাঈল (আ.) এসে নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সংবাদ দিলেন আপনি যা (শবে ক্বদর) তালাশ করছেন তা সামনে। অতঃপর তিনি পরবর্তী ১০ দিনের এতেকাফ করতে লাগলেন আমরাও তাঁর সঙ্গী ছিলাম। 


আবার জিব্রাঈল (আ.) এসে সংবাদ দিলেন আপনি যা (শবে ক্বদর) তালাশ করছেন তা আরও সামনে আসছে। তাই ২০ রামাদ্বান ভোরে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, আমার সাথে যারা এতেকাফ করতে আগ্রহী তারা যেন পুনরায় এতেকাফে বসে যায়। লাইলাতুল ক্বদর শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতেই হয়ে থাকে। আবু সাঈদ (রা.) বলেন, আমি দেখলাম আমি যেন কাদার মধ্যে সিজদা করছি (সহীহ বুখারী হাদীস নং ২০১৮)। 


সহীহ বুখারী শরীফে আছে (হাদীস নং ২০২০) হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা রামাদ্বানের শেষ ১০ দিনেই শবে ক্বদর অন্বেষণ করবে। হযরত আয়েশা (রা:) আরো বলেন, যখন রামাদ্বানের শেষ দশক আসত তখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশী বেশী ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্র জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন (সহীহ বুখারী হাদীস নং ২০২৪)। সহীহ মুসলিম শরীফে আছে হযরত ইবনে উমর (রা.) বলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা রামাদ্বানের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাতগুলোতে শবে ক্বদর অন্বেষণ কর। এ সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) এর অভিমত এই যে, (লাইলাতুল ক্বদর) এর মধ্যে ৯টি হরফ আছে এবং কোরআনে লাইলাতুল ক্বদর শব্দটি ৩ বার এসেছে, তাই (৩x৯)=২৭।


অতএব ২৭ রামাদ্বানুল মোবারকে শবে কদর হওয়ার বেশি সম্ভাবনা রয়েছে। হযরত ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ও এ মত পোষণ করেন।


শবে কদর অনির্দিষ্ট রাখার কারণ: 


হযরত উবাদা বিন সামিত (রা.) বর্ণনা করেন, একদা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শবে ক্বদর সম্পর্কে সংবাদ দেয়ার জন্য বের হলেন। কিন্তু এ সময় দুজন মুসলমানের মধ্যে বিবাদ চলছিল। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, আমি তোমাদেরকে শবে ক্বদর (সঠিক তারিখ) অবহিত করতে বের হয়েছিলাম কিন্তু এ সময় অমুক অমুক ব্যক্তির মধ্যে ঝগড়ার কারণে শবে ক্বদরের সঠিক তারিখ গোপন করে দেয়া হয়েছে। সম্ভবতঃ এ গোপনীয়তার মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তাই শবে ক্বদরের রাতকে তোমরা নবম, সপ্তম ও পঞ্চম রাতে তালাশ করবে (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০২৩)। উক্ত হাদীস শরীফে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তন্মধ্যে সর্বাগ্রে গুরূত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এ ঝগড়া বিবাদ যা দু‘জন মুসলমানের মধ্যে সংগঠিত হয়েছিল। এটা এতই কঠিন মন্দ কাজ, যার কারণে সর্বকালের জন্য শবে ক্বদরের নির্দিষ্ট তারিখ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আর শুধু এই নয় বরং পরস্পর ঝগড়া বিবাদ চিরদিনের জন্য কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়ার একটি কারণ হয়ে থাকে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তোমাদেরকে নফল নামাজ, নফল রোজা, সদকা খয়রাত ইত্যাদি থেকে উত্তম বস্তু কি বলে দেব না? সাহাবীগণ বললেন হ্যাঁ। তখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পরস্পরের মধ্যে সদ্ব্যবহার হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম কাজ। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ দ্বীনকে এমনভাবে মুন্ডন করে ফেলে যেভাবে ক্ষুর মাথার চুল কেটে একেবারে সাফ করে দেয়।


হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের ইজ্জত বিনষ্ট করাকে নিকৃষ্টতম উপার্জন বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যত্র বর্ণিত আছে, শবে ক্বদরে আল্লাহ পাকের সীমাহীন রহমত মাখলুকাতের প্রতি অবধারিত হয়ে থাকে এবং সামান্য ওছিলা-বাহানায় মাফ করে দেয়া হয়। তবে এ শুভ মুহুর্তে দুজনের ভাগ্যে মাগফিরাত নসিব হয় না, প্রথম কাফির আর দ্বিতীয় হচ্ছে যে অপর মুসলমান ভাইয়ের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করে। হাদীস শরীফে অন্যত্র উল্লেখ আছে, তিন ধরনের লোকের নামাজ কবুল হওয়ার জন্য তাদের মাথার অর্ধহাত উপরে যায় না এ তিন ব্যক্তির মধ্যে পরস্পর ঝগড়াকারীর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। যে দু’ব্যক্তির মধ্যে চলমান ঝগড়া-বিবাদের কারণে শবে ক্বদরের নির্দিষ্ট হওয়া গোপন করে দেয়া হয়েছে, কোন কোন মনীষীর মতে তারা হলেন আব্দুলল্লাহ বিন আবি জযরদ এবং কা’ব বিন মালেক (রা.)। এখানে একটি বিষয় লক্ষনীয়, প্রথমে বর্ণিত হাদীস শরীফে যে বলা হয়েছে, ‘শবে ক্বদরের নির্দিষ্ট হওয়া উঠিয়ে নেয়া হয়েছে’ তার অর্থ হল দু ব্যক্তির ঝগড়ার কারণে ক্বদরের সঠিক তারিখ আমার স্মৃতি থেকে মুছে দেয়া হয়েছে। এতে প্রমাণিত হল যে, পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ করা বা একে অন্যের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা অত্যন্ত জঘন্য কাজ। যার কারণে একজন ব্যক্তি সকল প্রকার বরকত ও পুণ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। 


সে বস্তু যতটুকু মূল্যবান ও গুরূত্বপূর্ণ হয় তা হাসিলের জন্যও ততটুকু কষ্ট শিকার করতে হয়। তাই শবে ক্বদরের মত মহামূল্যবান নিয়ামত ও অমূল্য রতন বিনা কষ্টে কীভাবে অর্জিত হবে। এজন্য এর সঠিক তারিখ গোপন রাখা হয়েছে। তাইতো হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সঠিক তারিখের সন্ধান না দেয়াটা তোমাদের জন্য শুভ হওয়ার লক্ষণ। (ইবনে কাছীর ৪র্থ খন্ড) তার মর্মার্থ হল, শবে ক্বদরের সঠিক তারিখ সম্পর্কে আমাকে যে নির্দিষ্টভাবে বাতানো হয়েছিল আর এ মুহুর্তে তা ভুলানো হয়েছে এর কারণ তা যদি নির্দিষ্টভাবে আমি তোমাদেরকে বলে দিতাম তবে তোমরা শুধুমাত্র ঐ রাতের উপর ভরসা করে বসে থাকতে। কিন্তু ঐ তারিখটি গোপন থাকার কারণে তার পুণ্য লাভের জন্য এখন তোমরা যে শুধু অতিরিক্ত কষ্ট ও চেষ্টা করবে তা নয় বরং ইবাদত বন্দেগীতে আধিক্য আসবে যা তোমাদের বেলায় পুণ্য লাভের অনন্য মাধ্যমে পরিণত হবে। বিখ্যাত তাফসীরবিদ আল্লামা ইবনে কাছীর দিমশকী (রহ.) বলেন, শবে ক্বদর গোপন রাখার মধ্যে আসল রহস্য এটাই হচ্ছে যে, শবে ক্বদর অন্বেষণে আগ্রহী লোকেরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সারাটা রামাদ্বান ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকে। (ইবনে কাছীর ৪র্থ খন্ড পৃষ্ঠা ৫৩৪)

শবে ক্বদরের নিদর্শন


হাদীস শরীফে শবে ক্বদরের যেসব আলামত বর্ণিত হয়েছে, যে রাতে এ সমস্ত আলামত পাওয়া যাবে, বুঝতে হবে, এ রাতেই শবে ক্বদর।


(১) সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও পরিক্ষীত আলামত হল শবে ক্বদরের ভোরে সূর্য কিরণবিহীন অবস্থায় পূর্ণিমার চাঁদের মত ঝলমল হয়ে উদিত হয়। অন্যান্য দিনের মতো প্রখর কিরণ বিদ্যমান থাকে না। (আইনী  শরহে বুখারী ৫ম খন্ড ৩৬৫ পৃষ্ঠা) এ নিদর্শনটি বহুলোকের পরীক্ষিত ও প্রত্যেক শবে ক্বদরে পাওয়া যায়।


(২) এ রাতে নক্ষত্রগুলো আপন কক্ষপথে স্থির থাকে মোটেই নড়াচড়া করে না। (ইবনে কাছীর)


(৩) ইমাম ইবনে জারীর (রহ.) কোন কোন বুর্জুগ থেকে বর্ণনা করেন যে, এ রাতে প্রত্যেক বস্তু সিজদাবনত হয় আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। (আইনী ৫ম খন্ড ৩৬৫ পৃষ্ঠা)


(৪) কোন কোন বিজ্ঞগণের পরীক্ষিত যে, শবে ক্বদরে সাগর ও কূপের লবণাক্ত পানি মিঠা পানিতে পরিণত হয়। (আরফুশ শাযী: পৃষ্ঠা ৩২৭)


(৫) কোন কোন লোক কিছু বিশেষ দর্শন করে থাকেন, তবে সেটা কোন বিশেষ নিদর্শন নয়, সাধারণ লোকের সেদিকে খেয়াল না করাটাই ভালো।


উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার যে, শবে ক্বদরের ফজীলত অপরিসীম। তাই গুরুত্বসহকারে একাগ্রচিত্তে শবে ক্বদর অন্বেষণ করা একান্ত জরুরি, যাতে আমরা সকলে ওই রাতে আল্লাহর দেয়া নেয়ামত লাভে ধন্য হয়ে দুনিয়া আখেরাতের কামিয়াবী লাভ করতে পারি। হে আল্লাহ! আমাদের সবাইকে শবে ক্বদরের বরকত, ফজীলত এবং রহমত দ্বারা ভরপুর করে দিন। আমীন।


লেখক: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক  ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা।


Post a Comment

0 Comments